প্রিয়জনের খবর নিতে পারেনি অনেকে রিমালে অচল ফোন-ইন্টারনেট ব্যাকআপ না থাকায় বিপর্যয়
সঞ্জয় ব্যানার্জী, পটুয়াখালী প্রতিনিধি ;
ঘূর্ণিঝড় রিমালের খারাপ সময়গুলোতে বিশেষ প্রয়োজনে ব্যবহারের মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ থাকায় চরম দুুরব¯’ায় পড়তে হয় সবাইকে। একদিকে যেমন উদ্ধারকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ ¯’াপনে সমস্যা হয়, তেমনি দুর্যোগ কবলিত এলাকার মানুষ ও উপকূলবর্তী আত্মীয় পরিজনদের খবর নিতে পারেনি স্বজনরা। রিমালের তান্ডবের চেয়েও এই আতঙ্কই বেশি ভুগিয়েছে মানুষকে। অবশ্য এমন ঘটনা এবারই প্রথম নয়, আইলা-নার্গিসসহ আরও কয়েকটি
ঝড়ের সময়ও এমনটি ঘটেছে। জরুরি পরিষেবার মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেটের সুবিধা বন্ধ হয়েছে ঝড় চলার মধ্যেই। যা চালু হয়নি পরবর্তী ২/৩ দিনেও। এ নিয়ে নানা সময়ে পত্র-পত্রিকায় খবরহলেও ঘুম ভাঙেনি মোবাইল অপারেটরদের। ফলে বারবার এভাবেই সাধারণ মানুষকে বিপদে পড়তে
হয়েছে।
বিদ্যুৎ না থাকলে কেন মোবাইল ফোনের সংযোগ থাকে না-এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে নতুন তথ্য পাওয়া যায়। এর পেছনে ছিল মোবাইল অপারেটরগুলোর ব্যয় সংকোচন নীতি। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে মোবাইল ফোন অপারেটরের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ‘বেইজ ট্রান্সমিটার স্টেশন বা বিটিএস’র মাধ্যমে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক চালু রাখে কোম্পানিগুলো। বিটিএস রেডিও সংকেতের মাধ্যমে মোবাইল ডিভাইসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কল বা ইন্টারনেট সংযোগ দেয়। এসব বিটিএস-এ আগে অটো জেনারেটর রাখত অপারেটররা।
বিদ্যুৎ চলে গেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হতো এসব জেনারেটর। বিদ্যুৎ না আসা পর্যন্ত চলত সেগুলো। এ ক্ষেত্রে জেনারেটরের তেল সরবরাহ করত কোম্পানিগুলো। এটি খানিকটা ব্যয়বহুল হওয়ায় অটো জেনারেটর থেকে সরে আসে তারা। পরিবর্তে দেওয়া হয় ব্যাটারি ব্যাকআপ। বিদ্যুৎ না থাকলে এসব ব্যাটারি ৫থেকে ৬ঘণ্টা পর্যন্ত সচল রাখে বিটিএস। তারপর বন্ধ হয়ে যায় স্টেশন। স্টেশন বন্ধ হলেই বি”িছন্ন হয়ে যায় মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেট সংযোগ। এ ঘটনা
ঘূর্ণিঝড় রিমালে যেমন ঘটেছে তেমনি আইলা-নার্গিসহ অন্যান্য ঘূর্ণিঝড়গুলোর সময়ও ঘটেছে। বিদ্যুৎ সংযোগ টানা ৭/৮ ঘণ্টা বন্ধ থাকলেই বন্ধ হয়ে গেছে মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেটের সংযোগ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অসংখ্য গ্রাহক। তবু ব্যাটারি ব্যাকআপ থেকে সরে আসেনি মোবাইল অপারেটররা।’
রোববার দুপুরের পর থেকে দেশের দক্ষিণ উপকূলে শুরু হয় রিমালের প্রভাব। ঝড় শুরু হতে না হতেই বন্ধ হয়ে যায় বিদ্যুৎ সরবরাহ। এর ৩/৪ ঘণ্টা পর থেকে শুরু হয় একের পর এক মোবাইলের সংযোগ বি”িছন্ন। বন্ধ হয়ে যায় মুঠোফোনের নেট ও ইন্টারনেট সংযোগ। ফলে পুরোপুরি যোগাযোগ বি”িছন্ন হয়ে পড়ে মানুষ। পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলার বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের দক্ষিন দাস পাড়া এলাকার বাসিন্দা সামছুল হক মাস্টার বলেন, ‘শনিবার বিকাল থেকেই বিদ্যুৎ ছিল না। রোববার সকাল নাগাদ বন্ধ হয়ে যায় মোবাইল ফোনের যোগাযোগ। ইন্টারনেটও কাজ করছিল না। রোববার যখন তীব্র ঝড় তখন কোনোভাবেই কোনো খবর পৌঁছাতে পারছিলাম না কোথাও। বৃহস্পতিবার শেষ বিকালে বিদ্যুৎ আসার পর ফের চালু হয় মোবাইল নেটওয়ার্ক।
এককথায় ঝড়ের পুরো সময়টাই বন্ধ ছিল মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেটের যোগাযোগ।’ সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটার সংবাদকর্মী উত্তম কুমার হাওলাদার বলেন, ‘রোববার থেকে আসা-যাওয়ার মধ্যে ছিল ফোনের নেটওয়ার্ক। নিরব”িছন্ন সংযোগ চালু হয় মঙ্গলবার রাতে। মাঝের ৪ দিন যোগাযোগে পোহাতে হয় চরম দুর্ভোগ।’নির্ভরযোগ্য সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, বরিশাল অঞ্চলের ৬ জেলায় মোবাইল অপারেটরের রয়েছে ১০ হাজারের বেশি বিটিএস। এবার রিমালে এর প্রায় সিংহভাগই ছিল অচল। ঝড়ের পর কিছু কিছু বিটিএস-এ নতুন ব্যাটারি ব্যাকআপ এবং জেনারেটর দেওয়া হলেও তা ছিল প্রয়োজনের তুলনায়
অপ্রতুল। যে কারণে টানা ৪ দিন বন্ধ থাকে অধিকাংশ এলাকার মোবাইল ফোন-ইন্টারনেটের
সংযোগ।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, গ্রামীণ ফোন ও বাংলা লিংকের বিটিএসগুলো তারা নিজেরাই পরিচালনা করে। নিজেরা বলতে তৃতীয় পক্ষ বা ভেন্ডারের মাধ্যমে এগুলোর পরিচালনা নিয়ন্ত্রণ করে তারা। স্টেশনের পাওয়ার ব্যাকআপসহ সবকিছু দেখভাল করে ওই ভেন্ডার। একমাত্র রবি তাদের বিটিএস সেবা নেয় ই.ডটকো নামে একটি টাওয়ার সোবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। ২০০৭ সালে আঘাত হানা সিডরের সময়ও এসব বিটিএস-এ চালু ছিল অটো জেনারেটর পদ্ধতি।
ফলে ঝড়ে টাওয়ার উপড়ে পড়লেও বিকল্প টাওয়ারে চালু থাকে মোবাইল ফোন ইন্টারনেট সংযোগ। অটো জেনারেটর পদ্ধতিতে বিটিএসগুলোতে তেল পৌঁছাতে হতো কোম্পানিগুলোকে। এ ক্ষেত্রে খরচ কিছুটা বেশি হওয়ায় জেনারেটর থেকে সরে এসে ব্যাটারি ব্যাকআপ চালু করা হয় বিটিএসগুলোতে।
স্বাভাবিক সময়ে এটা সমস্যা না করলেও প্রাকৃতিক দুর্যোগে যে কোনো কাজেই আসে না সেটা রিমালে আবারও স্পষ্ট হলো। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য মোবাইল অপারেটরগুলোর একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি কেউ।দশমিনা উপজেলা দূর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি ও দশমিনা প্রেসক্লাবের সভাপতিআহম্মেদ ইব্রাহিম অরবিল রহমান বলেন, সরকারের উচিত যে কোনো পরি¯ি’তিতে নিরব”িছন্ন মোবাইল নেটওয়ার্ক নিশ্চিত করতে মোবাইল অপারেটরগুলোকে বাধ্য করা। ঝড়ের কারণে দশমিনায় শনিবার বিকাল সাড়ে ৫টায় বি”িছন্ন হয় বিদ্যুৎ সংযোগ।
এর ঠিক৪/৫ ঘণ্টা পর বন্ধ হতে শুরু করে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক। বিদ্যুৎ না থাকায় বি”িছন্ন হয়ে যায় ওয়াইফাই সংযোগও। প্রায় একই অভিযোগ বাউফল উপজেলার মো. জসিম উদ্দিনসহ অনেকবাসিন্দার। পটুয়াখালী, ভোলা, ঝালকাঠি, পিরোজপুর ও বরগুনা থেকেও একই খবর আসে। যতক্ষণ
বিদ্যুৎ ছিল না, ততক্ষণ বন্ধ ছিল মোবাইল ও ইন্টারনেটের সংযোগ।